টিভিতে ‘টেলিভিশন বিতর্ক’ শুক্রবারে ‘ছায়া সংসদ’ হয়তো অনেকেই দেখে থাকেন। দেখে হয়তো মাঝে মাঝে মনেও হয়, “ইশ, বিতার্কিকেরা কI সুন্দর করে কথা বলে! আমিও যদি এভাবে যুক্তি দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম!”
বিতার্কিক হওয়া খুব কঠিন কিছু না। একটু কৌশল, শ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে আপনিও হয়ে উঠতে পারবেন তুখোড় একজন বিতার্কিক!
বিতর্ক হচ্ছে তর্কের খেলা। একটি নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিজের যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে যুক্তির আয়নার নিজের ভাবনাগুলোকে প্রতিফলিত করা যায়। এর ফলে বাড়ে চিন্তার পরিধি, জ্ঞান আর প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান। একটি বিষয়কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে কীভাবে আর কতভাবে ভাবা যায়, তা একজন বিতার্কিকের থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না।
একজন ভালো বিতার্কিক হতে হলে যে বিষয়গুলো আয়ত্ত্বে না থাকলেই নয় সেগুলো হচ্ছে-
১) বিষয়জ্ঞান: বিতর্ক করতে হলে প্রয়োজন তথ্যবহুল যুক্তি। প্রতিপক্ষের যুক্তি ঘায়েল করে বিচারকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন ঠিক বিষয়ে ঠিকঠাক যুক্তি তথ্য প্রদান। আর সেজন্য প্রয়োজন বিষয়বস্তুর ওপর জ্ঞান থাকা। বিতর্কের বিষয় সাধারণত সমসাময়িক বিষয়ের উপর বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে। সুতরাং, পত্র-পত্রিকা পড়া, প্রচুর বই পড়া এবং আপডেটেড থাকলে যেকোনো বিতর্কের যেকোনো বিষয় নিয়ে সহজেই পাঁচ মিনিট কথা বলা যাবে।
২) বিতর্কের বিষয়ের ব্যবচ্ছেদ: বিতর্কের পূর্বেই একটি নির্ধারিত বিষয় দেয়া থাকে। বিতর্কভেদে সেই বিষয় একদিন, এক ঘন্টা, আবার অনেক সময় বিতর্ক শুরুর মাত্র ১৫ মিনিট আগেও দেয়া হয়। সুতরাং, স্বল্প সময়ের মাঝে পুরো বিতর্কটি ধরতে পারা এবং নিজের দলের অবস্থান প্রতিপক্ষ থেকে দৃঢ় করার জন্য বিতর্কের বিষয়ের সঠিক ব্যবচ্ছেদ অত্যাবশ্যক।
৩) কাঠামো সাজানো: পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে যাতে দলের অবস্থান বিচারক, প্রতিপক্ষ ও দর্শকদের কাছে পরিষ্কার হয়, সেজন্য প্রয়োজন কাঠামোবদ্ধ বিতর্ক করা। বিতর্কের ভাষায় একে ‘কেস ফ্রেমিং’ বলে। বিতর্কের শুরুতে প্রতিপক্ষের পূর্ববর্তী বক্তার যুক্তিগুলোর ভুলগুলো দেখিয়ে বক্তব্য শুরু করা, নিজের যুক্তিগুলো প্রতিষ্ঠিত করা ও নিজের দলের যুক্তিগুলো কেন প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলোর চেয়ে ভালো সেই সম্পর্কে একটি তুলনামূলক আলোচনা করে নিজের দলের অবস্থান দৃঢ় করা- এ সবই নির্ভর করে ফ্রেমিংয়ের উপর। অর্থাৎ, কোন জিনিসের পর কোন জিনিস কীভাবে বলবে, সেটিই হচ্ছে বিতর্কের ফ্রেমিং। বিষয়জ্ঞান ভালো থাকার পরেও অনেক সময় ঠিকভাবে ফ্রেমিং করা না হলে নিজেদের দলীয় অবস্থান পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না।
৪) নির্ধারিত বক্তার দায়িত্ব পালন: সাধারণত বিতর্কে প্রতি দলে তিনজন করে বক্তা থাকেন। তিনজন বক্তার দলীয় ভূমিকাও আলাদা হয়। প্রথম বক্তা বিতর্কের বিষয়টির প্রধান প্রপঞ্চগুলোর ব্যাখ্যা ও নিজেদের স্বপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় বক্তা প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলো খন্ডনের পাশাপাশি নিজেদের যুক্তিগুলো ব্যাখ্যা ও সংশ্লিষ্ট উদাহরণ প্রদান করেন। শেষ বক্তা প্রতিপক্ষের যুক্তি খন্ডনের পাশাপাশি দুই পক্ষের সার্বিক বিতর্কের হেড-টু-হেড একটি তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়ে দিয়ে যান কী কারণে তাদের পক্ষের যুক্তিগুলো অধিকতর জোরালো ছিল এবং কোন ভুলগুলোর কারণে প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
৫) সমন্বয়: বিতার্কিক হতে হলে বিষয়ের সমন্বয়জ্ঞান থাকা জরুরি। মনে রাখবেন, একজন ভালো বিতার্কিককে সবদিকে সমান নজর দিতে হয়। ধারালো যুক্তির পাশাপাশি সমন্বয় না করলে যুক্তিগুলো তখন আর শুনতে ভালো শোনায় না। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে, প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলোর সাথে মিলিয়ে নিজের যুক্তির দিকে, তুলনামূলক জায়গা থেকে দুই দলের পার্থক্য দেখালে সেটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয় বিচারকদের কাছে।
৬) সময়জ্ঞান: সময় গেলে সাধন হয় না। তেমনিভাবে নির্ধারিত সময়ের পরেও আর বক্তব্য গ্রহণ করা হয় না। বিতর্কের মঞ্চে তাই অত্যন্ত সময়ানুবর্তী হতে হয়। পাঁচ মিনিটের বক্তব্য যাতে পাঁচ মিনিটের মাঝেই শেষ হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রেখেই নিজের বক্তব্য দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় শুরুর দিকে অনুশীলন করার সময় সামনে একটি স্টপওয়াচ রেখে কথা বললে। তাহলে পুরো বক্তব্য কোনদিকে যাচ্ছে, আর কতক্ষণের মাঝে শেষ করতে হবে তা মাথায় রেখে সেভাবে কথা বলা সম্ভব। মনে রাখবেন, চার মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডে বসে পড়াকে বিচারকরা যেমন আপনার দুর্বলতা হিসেবে ধরে নেবেন, তেমনিভাবে পাঁচ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডের পর বক্তব্য শেষ করাও নেগেটিভ মার্কিংয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং, সময় নিয়ে সাবধান!
৭) উপস্থাপনা: বিষয় হোক যা-তা, উপস্থাপনা হোক ভালো। সুন্দরভাবে কথা বলতে জানলে সবাই আকৃষ্ট হবেই! তার মানে এই না যে আপনার কন্ঠ অনেক মিহি আর সুরেলা হতে হবে। এখানে উপস্থাপনা বলতে আপনার অভিব্যক্তি, কন্ঠের জোর ও আত্মবিশ্বাসকে বোঝানো হয়েছে। যুক্তিতর্কের সময় বক্তার উপস্থাপনা ও বচনভঙ্গি যেন সাবলীল ও জোরালো হয়। পুরো বক্তব্য হয়তো মুখস্ত রেখে বলা সম্ভব না। সেজন্য চাইলে একটি ছোট কাগজে মূল পয়েন্টগুলো লিখে সেটি হাতে রেখে কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু পুরো সময়জুড়ে স্ক্রিপ্ট দেখে কথা বলা, কথার মাঝে আটকে যাওয়া, যথাযথ আই-কন্টাক্ট না রাখা- এ জিনিসগুলো উপস্থাপনার সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দেয়।
৮) ভালো শ্রোতা হওয়া: ভালো বক্তা হওয়ার প্রধান পূর্বশর্ত হলো ভালো শ্রোতা হওয়া। বিতর্ক জেতার অর্ধেক নির্ভর করে নিজ দলের যুক্তি প্রমাণের উপর, আর বাকি অর্ধেক নির্ভর করে প্রতিপক্ষের ভুলগুলো ধরতে পারার উপর। প্রতিপক্ষের বক্তার বিতর্কের সময় কেউ যদি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে ভাবতে থাকে, তবে সে অপরপক্ষের বক্তব্যের ভুল দিকগুলো আর চিহ্নিত করতে পারবে না। সুতরাং, প্রত্যেকের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিজের বিতর্ক সাজাতে হবে।
৯) বিতর্ক দেখা: প্রচুর পরিমাণে বিতর্ক দেখতে হবে। ভালো বিতার্কিকেরা কীভাবে বিতর্ক করেন, তাদের কৌশলগুলো কী এসব না দেখলে শেখা যায় না। সময় পেলে ভালো কোনো বিতর্কের প্রোগ্রামে চলে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। সময় কম হলে ইন্টারনেটে বসেই দেখে নিতে পারেন বিভিন্ন বিতর্কের অনুষ্ঠান। ইউটিউবে সার্চ দিলেই আজকাল অনেক বিতর্কের ভিডিও পাওয়া যায়।
তাহলে আর দেরি কেন! আজ থেকেই বিতর্কের চর্চা শুরু করে দিন। কে জানে, হয়তো আপনার মাঝেই লুকিয়ে আছে এ্যাডভান্সড রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের আগামীর সেরা একজন বিতার্কিক!
Leave a Reply